পুরা দুনিয়াটাই হচ্ছে একটা ছবির মতন। এই দুনিয়া অস্তিত্ব থাকলেও যা অস্তিত্ব না থাকলেও তাই। কিন্তু এর বাস্তবতা রয়েছে অনন্তকালের আগের থেকে অনন্ত পর্যন্ত। ৪০ বছর আগে আমার শিক্ষক আমাকে হুকুম করেছিলেন রজব মাসে আর শাবান মাসে সেকলুশন করতে। সেই জায়গাটা ছিল বাগদাদে। সাইয়িদিনা শেখ আল-বাস (লাল বাজপাখি) আব্দুল কাদের জিলানীর মাকামে। আমার শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মদিনা-মুনাওয়ারাতে। সর্বাধিক চমৎকার নেয়ামত এবং শান্তি এর বাসিন্দাদের উপর অর্পিত হোক। সেখান থেকেই তিনি আমাকে সেকশনে যাওয়ার হুকুম দেন। আমি তখন ছিলাম দামাস্কাসে।
আমি যখন বাগদাদে পৌছালাম সেখানে কুর্দিস্তান থেকে কিছু মানুষ এসেছিলেন মাওলানা শেখ আল-বাসের সাথে দেখা করতে। এখানে দেখা করতে বলতে আমি বুঝাচ্ছি উনার মাজার শরীফ জিয়ারত করতে। সেদিন রাত্রে আমি তাদের কাছাকাছি ঘুমিয়েছিলাম। তারা আমাকে বললো যে পরের দিন সকালে তারা তাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হবে সাইয়িদিনা আব্দুল কাদের জিলানীর অনুমতিক্রমে। পরের দিন সকালে আমি নিচে নেমে আসলাম আর খোলা জায়গাটার মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটা মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসলো। তার মাথায় কোনো টুপিও ছিল না আর তার গায়ে ছিল একেবারে সাধারণ কাপড়-চোপড়। তার গঠন ছিল সুন্দর। তাকে দেখে মোটেও দরবেশ মনে হচ্ছিল না।
সে আমার পাশ থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসলো আর আমাকে বললো, "আসসালামু আলাইকুম ও শেখ"।
আমি জবাব দিলাম, "ওয়ালাইকুম সালাম"।
সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কি শেখ নাজিম?"
আমি বললাম, "হ্যা"।
"আর আপনি দামাস্কাস, শাম শরীফ থেকে এখানে এসেছেন সেকলুশন এর জন্য?"।
আমি বললাম, "হ্যা"।
তখন সে আমাকে বললো, "গতকাল রাত্রে আমি একটা মজলিসের ভিতর ছিলাম আর সেখানে আমার শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন, 'শোনো আগামীকাল আমার ছেলে আসছে শাম শরীফ থেকে। সে এখানে থাকবে আর সেকলুশন করবে ৪০ দিনের জন্য। সে মাকামের বাইরে কোথাও যাবেনা আর তার যা কিছু লাগবে তুমি তার কাছে নিয়ে গিয়ে দিবা'। ও শেখ নাজিম, আমাকে হুকুম করা হয়েছে আপনার যা কিছু লাগবে আগামী ৪০ দিন সেটার ব্যবস্থা যাতে আমি করি সেজন্য। যেহেতু আপনি অন্য কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না সেই জন্য শুধুমাত্র আমি আসব আর আপনি আমাকে জানাবেন আপনার কি লাগবে। সব কিছুর ব্যবস্থা আমি নিজে করব আপনার জন্য আগামী ৪০ দিন, কি যতদিন আপনি এখানে আছেন ততদিন।"
আমি সেকলুশনে ছিলাম পুরা ৪০ দিন। আর সুলুকের জন্য যেটা এক ধরনের রুহানি শৃঙ্খলা, পদযাত্রার জন্য ৫০ দিন। যখন আমার সেকলুশন শেষ হলো আমি আমার শেখের কাছে একটা খবর পাঠিয়েছিলাম অনুমতি চেয়ে, যাতে আমি শাম শরীফে ফিরে যেতে পারি।
সেই লোকটা প্রত্যেকদিন আমার কাছে নিয়ে আসতো যা কিছু আমার লাগবে। খাবার ছিলো ডালের সাথে রুটি। প্রত্যেক দিন ভোর রাত্রে রাতে তিন ভাগের এক ভাগ যখন বাকি থাকতো, তখন আমি নিচে নেমে আসতাম। সুলতানের মাকামের পিছন দিকে তারা সেখানে নতুন একটা দালান তৈরি করেছিল। সেখানে প্রত্যেক দিন সকাল থেকে এশার নামাজ পর্যন্ত আমি একা একা বসে থাকতাম। এটা ছিল আমার সেকলুশন এর রুটিন। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি সেটা শেষ করতে পেরেছিলাম। এ বিষয়ে কথা বলতে আমার খুবই লজ্জা লাগছে কিন্তু তোমরা যখন এই বিষয়টা উপস্থাপন করেছ তখন এই বিষয়ে কথা না বলেও আমি আর পারলাম না।
আমার সেকলুশনের একেবারে শেষে যখন আমি শাম শরীফে ফিরে যাবার অনুমতি পেলাম তখন সেই লোকটা শেষ বারের মত আমার কাছে আসলো।
তাকে আমি বললাম, "ও আমার শেখ আমার এখানে কাজ শেষ আর আমি আপনার কাছে অনুমতি চাচ্ছি যাতে আমি আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারি"।
তিনি জবাব দিলেন, "হ্যাঁ তোমার ফিরে যাওয়ার অনুমতি আছে। তবে আমার একটা অনুরোধ আছে। তুমি যেই জোব্বাটা গায়ে দিয়ে নামাজ পড়তে সেই জোব্বাটা আমি চাই। যেই জোব্বার কথা উনি আমাকে বললেন সেটা আমি দামাস্কাস থেকে কিনেছিলাম ১২০ সিরিয়ান দিনার দিয়ে। যারা দরবেশ তারা এই ধরনের জোব্বা গায়ে দিত।
উনি আমাকে বললেন, 'এটা আমি চাই' কাজেই আমি সেটা উনাকে দিয়ে দিলাম। উনি আমার কাছ থেকে সেটা নিলেন আর তারপরে আমাকে সালাম দিলেন। এরপরে পিছন দিকে এক পা পেছালেন, তারপরে আরেক পা। তৃতীয় পা পিছনে যাওয়ার পরে উনি আমার চোখের সামনে গায়েব হয়ে গেলেন। এই ছিল আমার সেকলুশন এর জন্য সুলতান এর তরফ থেকে উপহার। তিনি আমাকে তার ছেলে বলে ডেকেছিলেন। সেটা আমার জন্য এক বিশাল সম্মান। যদিও আমি কিভাবে তার ছেলে হই?
কপিরাইট 2024 sufilive.com