মাওলানা শেখ হিশাম কাব্বানী (ق)
৩০শে জুলাই, ২০১২, ফেন্টন জাউইয়া, মিশিগান।
ফজরের পরে সোহবত।
আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
নাওয়াইতুল আরবাঈন, নাওয়াইতুল ইতেকাফ, নাওয়াইতুল খালওয়া, নাওয়াইতুল উযলা,
নাওয়াইতুর রিয়াদাহ, নাওয়াইতুস সুলুক, লিল্লাহি তা'আলা ফি হাদাল মসজিদ।
অর্থঃ আমি নিয়ত করছি এই মসজিদের ৪০ দিন ইতিকাফ করার, নিয়ত করছি নির্জন বাসের, নিয়ত করছি একাকীত্বের, নিয়ত করছি আত্মশুদ্ধির ও আধ্যাত্মিক পথে চলার, আল্লাহ্র জন্য, এই মসজিদে উপস্থিত অন্য সবার সাথে।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡكُمۡ
অর্থঃ হে ইমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যাদের হুকুম দেবার ভার আছে তাঁদের। [সূরাঃ নিসা আয়াত ৫৯]
নবীজীর ﷺ জামানায় কাগজের প্রচলন ছিলো না, তাই উনার ভবিষ্যতবাণী ছিলো অত্যন্ত চমকপ্রদ বা বিষ্ময়কর। আমরা এখন বুখারী ও মুসলিম শরীফে থাকা জিকির সম্পর্কে আলোচনা করছিঃ
عن معاذ بن جبل قال: قال رسول الله : { ألا أخبركم بخير أعمالكم وأزكاها عند مليككم، وأرفعها في درجاتكم، وخير لكم من إنفاق الذهب والفضة، ومن أن تلقوا عدوكم فتضربوا أعناقهم، ويضربوا أعناقكم } قالوا: بلى يا رسول الله. قال: { ذكر الله عز وجل }
অর্থাৎঃ তোমরা কি জানতে চাও যে, তোমাদের আমলের মধ্যে কোনটি আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে পবিত্র, যা তোমাদের উচ্চতর স্তরে নিয়ে যায় এবং সোনা ও রুপা ব্যয় করার থেকেও উত্তম?
(বুখারি ও মুসলিম)
ভবিষ্যদ্বাণী হলো যে এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ সোনা ও রূপা মওজুত করবে এবং অন্যান্য সবকিছুর কোনো মূল্য থাকবে না। আজকের দিনে কাগজের টাকার কোনো প্রকৃত মূল্য নেই; সবকিছু সোনা ও রূপার উপর নির্ভর করে, যেমনটি নবী ﷺ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এমন এক সময় আসছে যখন আপনার জন্য সঞ্চয় করার সবচেয়ে ভালো জিনিস হবে সোনা ও রূপা। আর সোনা ও রূপা সঞ্চয় করার চেয়েও উত্তম হলো আল্লাহর জিকির করা। এটাই জিহাদ যা অন্য যেকোনো কাজের চেয়ে উত্তম, এবং একবার “আল্লাহ” বলা এই পৃথিবীর যেকোনো কিছুর চেয়ে উত্তম! এর অর্থ হলো আপনি সেই মহান সত্তাকে ডাকছেন, যিনি এই মহাবিশ্বের সবকিছুর দ্বারা প্রশংসিত।
قُلِ الله ثُمَّ ذَرْهُمْ فِي خَوْضِهِمْ يَلْعَبُونَ
অর্থঃ "বলুন, আল্লাহ। তারপর তাদের তাদের খেয়ালখুশি ও নিরর্থক বিতর্কে মগ্ন থাকতে দিন, তারা খেলায় মত্ত থাকুক।" [সূরা আল আনআমঃ৯১]
যখন আল্লাহর কোনো বান্দা তাঁর কাছে এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁকে ডাকে, “তুমি আমার স্রষ্টা আর আমি কিছুই না,” এটা আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) পছন্দ করেন। একবার “আল্লাহ” বলাটাও এই পৃথিবীর সমস্ত সোনা ও রূপার চেয়ে উত্তম, কারণ সোনা এবং রূপা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর জিকির চিরস্থায়ী। কালামুল্লাহ কখনো শেষ হয় না এবং এখানে এর অর্থ “জিকিরুল্লাহ।”
قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا
অর্থঃ বলুন, “যদি সমুদ্র আমার প্রভুর বাণী লিখার কালি হয়ে যেত, তবে সমুদ্র শেষ হয়ে যেত আমার প্রভুর বাণী শেষ হওয়ার আগেই, এমনকি আমরা এর অনুরূপ আরেকটি সমুদ্র আনলেও।”
যদি পৃথিবীর সব গাছপালা কলম হয়ে যেত এবং সমুদ্রের পর সমুদ্র কালি হয়ে যেত, তবুও আল্লাহর বাণী শেষ হতো না! যদি সমস্ত সমুদ্র কালি হয়ে যেত, তা এক বিরাট পরিমাণ হতো; এত কালি দিয়ে আপনি কী করবেন? এবং যদি সব গাছ কলমে পরিণত হতো, তবুও আল্লাহর বাণী লিখে শেষ করা যেত না। এর অর্থ হলো, আমাদের অস্তিত্ব, এই মহাবিশ্ব এবং ফেরেশতাগণ সব শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহর পবিত্র বাণী চিরকাল থাকবে!
সুবহানআল্লাহ, এটি আমাদের কল্পনার বাইরে!
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلً خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا
অর্থঃ যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য জান্নাতুল ফিরদাউস হবে অতিথিশালা। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে এবং সেখান থেকে অন্য কোথাও যেতে চাইবে না।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) তাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস চিরস্থায়ী আশ্রয়স্থল হিসেবে দান করবেন এবং তারা আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। যদি সমুদ্রের সমস্ত পানি কালির মতো হয়ে যেত, তবুও তা আল্লাহর বাণী লিখতে যথেষ্ট হতো না। এমনকি আরও অনেক সমুদ্র নিয়ে আসা হলেও তা শেষ হয়ে যেত, কিন্তু আল্লাহর বাণী শেষ হতো না! আল্লাহ বলছেন, “এবং এটা আমি তোমাকে দিচ্ছি, হে মুহাম্মাদ! বল ‘আল্লাহ’ এবং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ এটি তোমার চাবি!”
একবার জীবনে “আল্লাহ” বলো, তাঁকে ডাকো, এবং তিনি উত্তর দেবেন, “হে আমার বান্দা, তুমি কি চাও?” যখন তুমি কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছে সাহায্যের জন্য কিছু চাও, তারা কি উত্তর দেয়? না। বরং তারা তাদের কুকুরের প্রতি যত্নশীল, যাদের তারা বিমানেও সঙ্গে নিয়ে যায়। কুকুরদের প্রতি তাদের যত্ন মানুষের চেয়ে বেশি। তারা প্রতিদিন কুকুরদের সাজানোর জন্য পাঠায় এবং বিমানেও তাদের আগে পাঠানো হয়, যেন কুকুর তাদের মালিকদের নেতৃত্ব দেয়। প্রথম শ্রেণী কুকুরদের জন্য, আর দ্বিতীয় শ্রেণী নেতাদের জন্য। তারা কি তোমাকে কিছু দেয়? নাহ্। উল্টা তারা তোমার কাছ থেকে নেয়, কারণ তুমি তাদেরকে আয়কর দাও, দিতে বাধ্য হও তুমি। তুমি যদি বলো, “আমার সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত নেই।” তারা বলবে, “ঠিক আছে, বুঝলাম, কিন্তু তবুও তোমাকে তোমার উপার্জনে কর দিতে হবে।”
আল্লাহ বলেন, “আমাকে স্মরণ করো, বলো ‘আল্লাহ,’ আর আমি তোমাকে এমনভাবে স্মরণ করব যা তুমি যেভাবে আমাকে স্মরণ করো তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তম।”
أنا جليس من ذكرني
আনা জালিসু, মান জাকারানি,
“আমি তার সঙ্গী, যে আমাকে স্মরণ করে।” (আহমদ, বায়হাকি)
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) আপনার সঙ্গে বসে আছেন (আনা জালিসু, মজলিস, যেখানে মানুষ পাশাপাশি বসে থাকে) কিন্তু এর অর্থ শারীরিক ভাবে নয়, বরং তিনি আপনাকে তাঁর সুন্দর নাম ও গুণাবলি (আসমা অয়া সিফাত) দ্বারা অলংকৃত করছেন। কিয়ামতের দিন, যখন আপনি সেই অলংকরণ নিয়ে উপস্থিত হবেন, যা চাঁদ বা সূর্যের মতো দীপ্তিময় হবে, তখন সবাই আপনাকে দেখে বিস্মিত হবে! আস-সুহরওয়ার্দি (রহ.) বর্ণনা করেছেন যে, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) বলেছেন: যদি আমার স্মরণ আমার বান্দার উপর প্রবল হয়ে যায় এবং সে আমাকে স্মরণ করার আকাঙ্ক্ষায় অভিভূত হয়, তবে আমি তার সমস্ত আনন্দ এবং চিন্তা আমার স্মরণে সীমাবদ্ধ করে দেব। (আস-সুহরওয়ার্দি)
এর অর্থ হলো, “আমার স্মরণ ছাড়া তার কাছে আর কোনো মিষ্টতা থাকবে না।” যে কেউ আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) তার সঙ্গে থাকেন, যদিও শারীরিকভাবে নয়, যেমনটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
যদি আমি তার চিন্তা ও মনোযোগকে আমার স্মরণে সীমাবদ্ধ করি, তবে সে আমার প্রতি গভীর ভালোবাসায় আবিষ্ট হয়ে যাবে। (আস-সুহরওয়ার্দি)
তখন সে শুধু ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ইশক-এর অবস্থায় পৌঁছাবে, যা একটি আরও গভীর এবং তীব্র ভালোবাসা। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) বলেন:
"আমি আমার এবং তার মধ্যে থাকা পর্দাগুলো সরিয়ে দিই।" (আস-সুহরওয়ার্দি)
এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা আওলিয়া-ই-কিরামকে বলেন, "দুঃখিত হয়ো না! আমার কাছে এসো, দ্রুত আমার দরজায় পৌঁছাও! আমি আমার এবং তোমার মাঝে দরজাগুলো খুলে দিচ্ছি, কারণ তুমি আমার প্রতি গভীর ভালোবাসায় আবদ্ধ। তুমি আমার স্মরণ ছাড়া শ্বাস নিতেও পারো না, ছাড়তেও পারো না, তাই দ্রুত এসো, কারণ আমার দরজা তোমার জন্য খোলা!"
তবে এর কিছু শর্ত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আহমদ আল-বাদাওয়ি (রাহমাতুল্লাহ আলাইহ) তাঁর প্রভুকে ডেকে বলেছিলেন, "আমি আপনার দরজায় পৌঁছে গেছি, আমাকে চাবি দিন!"
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) বললেন, "না, ওই ব্যক্তির কাছে যাও, তার কাছে তোমার চাবি আছে।"
ওই ব্যক্তি তার কাছে এসে বললেন, "তুমি কি চাবি চাও?"
আহমদ আল-বাদাওয়ি (রহ.) উত্তর দিলেন, "না, আমি চাবি চাই শুধুই আমার মালিকের কাছ থেকে।"
আল্লাহ বললেন, "আমি আল্লাহ! তুমি কি মনে কর আমি সরাসরি তোমাকে চাবি দেব? তুমি কি নিজের জন্য লজ্জা লাগে না? আমার এমন কিছু বান্দা আছে, যাদের প্রতি আমি আমার বিশ্বাস স্থাপন করেছি, এবং তারাই তোমার চাবি তোমার কাছে পৌঁছে দেবে!"
কিন্তু তিনি ওই ব্যক্তি থেকে সেই চাবি গ্রহণ করতে চাচ্ছিলেন না, কারণ তিনি সরাসরি আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) -র কাছ থেকেই তা চাইছিলেন। ওই আওলিয়াকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পর, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) তাকে ছয় মাস একেবারে একা আর অসহায় অবস্থায় রেখে দেয়ার পর উত্তর দিলেন, "যাও আর ওই লোকটাকে খুঁজে বের করো, তার কাছে তোমার চাবি আছে, কিন্তু এখন তার জন্য তোমাকে মূল্য দিতে হবে।"
সেই আওলিয়ার কাছে চাবিটা ছিল, কিন্তু আহমদ আল-বাদাওয়ি (রহ.) সেটা দেখতে ব্যর্থ হলেন। তারপর সেই আওলিয়া উপস্থিত হয়ে বললেন, "তুমি কি চাবি চাও?"
"হ্যাঁ," তিনি উত্তরে বললেন, "বিনিময়ে তুমি যা চাও আমি সেটাই তোমাকে দেব!"
তিনি বললেন, "না, এখন এটা কিছু শর্ত সহ। আমাকে তোমার সেই জ্ঞান দাও, যা তোমার আত্মবোধের সাথে মিশে আছে। তুমি মানুষকে জ্ঞান দিতে পারো না, কারণ তা অপবিত্র এবং গর্বের সাথে মিশ্রিত।" আহমদ আল-বাদাওয়ি (রহ.) সেই আওলিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে যে, সবচাইতে বড় চারজন ইমাম এবং অন্যান্য উলামায়ে কিরাম সব সময় আওলিয়া-ই-কিরামের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আবু হানিফা (রহ.) ইমাম জাফর সাদিক (রহ.) এবং বিশর আল-হাফি (রহ.) এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ইমাম মালিক (রহ.) ছিলেন কয়েক শত সুফি শায়েখের নীচে। ইমাম শাফি (রহ.) এবং ইমাম আহমদ (রহ.) শায়বান আর-রাই (রহ.) এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যদিও তাঁরা সবাই ইসলাম এবং ফিকাহ্ শাস্ত্রে অত্যন্ত জ্ঞানী ছিলেন, তবুও তাঁরা আওলিয়া-ই-কিরামের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, কারণ তাঁদের কাছে ছিল কেবল ইলম আয-যাহির। ইমাম শাফি` (রহ.) শায়বান আর-রাই (রহ.) এর ওযুর পানি পান করতেন এবং ইমাম আহমদ (রহ.) এতে আপত্তি করেছিলেন, তবে এই মুহূর্তে আমরা সেই আলোচনায় যাচ্ছি না।
সাইয়িদিনা আবু ইয়াযিদ আল-বিস্তামি (ق) - তিনিও তাঁর প্রভুর কাছে যান এবং তাঁর চাবির কথা জিজ্ঞেস করেন। উত্তর আসে, “যাও এবং আমার সৃষ্টির জন্য নিজেকে নীরব করে ফেলো।” অর্থাৎ, বিনয়ী হয়ে যাও। ইমাম আহমদ আল-বাদাওয়ি (ق) ঐ আওলিয়ার কাছ থেকে চাবি নিতে বাধ্য হন এবং আবু ইয়াযিদ আল-বিস্তামিকে (ق) নীরব হতে হয়, কারণ তারা দু’জনেই তাদের অর্জিত জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। তোমাকে অবশ্যই জীবনে সদা বিনয়ী হতে হবে, শুধুমাত্র চাবি নেওয়ার সময় নয়, কারণ তুমি বিনয়ী না হলে কোন কিছুই তোমার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। বিনয় কি? বিনয় হলো কখনও কারো উপর চিৎকার না করা এবং তাদের হৃদয় না ভাঙা, কারো মনে আঘাত না দেয়া, কখনও গর্বিত বা অহংকারী না হওয়া, নিজের সুবিধার জন্য মিথ্যা না বলা, বা ইসলামকে শুধুমাত্র টাকা উপার্জন বা সংগ্রহের একটি ব্যবসায় পরিণত না করা।
ইবনে তাইমিয়া এটি স্বীকার করেছিলেন, এবং যদিও আমরা আকীদায় আলাদা—তারা নৃতাত্ত্বিকতা (anthropomorphism) ধারণায় বিশ্বাসী—তবুও কিছু দিক রয়েছে যেগুলোতে আমরা একমত। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে তাইমিয়া তাসাউফে বিশ্বাস করতেন; তিনি তাসাউফকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন: প্রথমত, সঠিক সুফি, যাদেরকে তিনি নিজে অনুসরণ করতেন (১), (একেবারে শেষে সূত্র দেখুন); তারপর দ্বিতীয় শ্রেণী উল্লেখ করেছিলেন, মুহতারিফূন, যারা এটাকে একটা পেশা বানাচ্ছেন এবং ব্যবসায় পরিণত করছেন (তারা বলে, "যদি তোমার টাকা থাকে তবে তুমি শায়খের টেবিলে খাবার খেতে পারো; যদি টাকা না থাকে, তবে দরজায় দাঁড়াও এবং অপেক্ষা করো," এবং তারা সবার পরীক্ষা নেয় যারা কিনা তাঁদেরকে জিয়ারত (দর্শন) করতে আসে।) তৃতীয় শ্রেণী হল মুহতাকিরূন, যারা শেখের অনুসারীদের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং শেখের কাছ থেকে পয়সা উপার্জন করাটাকে নিজেদের পেশায় পরিণত করে ফেলেছে।
ইবনে তাইমিয়া একমত যে প্রকৃত আওলিয়ায়ে কিরাম থাকা অপরিহার্য। আজকাল দেখা যায়, অনেকে তরীকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে এবং শেখকে ক্ষমতাহীন করে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার অন্যরা সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে এবং যা কিছু সম্ভব সংগ্রহ করছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) সাইয়্যিদুনা আবু ইয়াযিদ আল-বিস্তামি (রহ.)-কে বলেছিলেন, “যদি তুমি আমার দরজায় আসতে চাও, নিজেকে একটি আবর্জনার স্তূপ বানাও,” যার অর্থ “নিজেকে সমর্পণ করো।” তাই, যদি তুমি শেখের অনুসরণ করতে চাও, তবে শেখকে অনুসরণ করো, কারণ তার দুনিয়ার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। তাদের অনুসরণ করো না যারা তোমাকে বিভ্রান্ত করবে। যদিও তাদের শিক্ষাগুলো পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে হতে পারে, কিন্তু তা তোমার জন্য বিষ হতে পারে।
যেমন আহমাদ আল-বাদাওয়ি (রহ.) তার পবিত্র কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানকে গড়ে তুলেছিলেন নিজের অহংকারের (নফস) উপর ভিত্তি করে, তাই তাকে কেটে ছেঁটে ছোট করে নিতে হয়েছিল। বলা হয়েছিল, “যদি তুমি ওলী হতে চাও, তবে তোমার সময়ে সবচেয়ে নিম্নস্থ ব্যক্তির কাছে গিয়ে নিজেকে বিনয়ী করো, যে ব্যক্তি বলেছিল, ‘আমি তোমার চাবি নিয়ে এসেছি!’”
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
رب اشعث اغبر لو اقسم على الله لأبره
রুব্বা আশ'আথ আঘবারা লাও আক্সামা 'আলা'ল্লাহি লা-আব্বারাহ।
"হয়তো এমন একজন অসহায়, ধূলিমলিন ব্যক্তি রয়েছে, যে যদি আল্লাহর নামে কোনো শপথ করে, তবে আল্লাহ তা পূরণ করবেন।" (মুসলিম শরীফ)
সুতরাং আল্লাহ আওলিয়ায়ে কিরামকে এরকম মানুষের কাছে পাঠান তাদের কাছ থেকে বিনয় শিখে নেয়ার জন্য। এমনকি তুমি যদি শেখের পাশে থেকে তার যত্ন নাও বা তাকে খাবার পরিবেশন করো, তবুও তোমার খারাপ শক্তির মাধ্যমে তুমি তাকে বিষাক্ত করতে পারো! অতীতে অনেক তরিকার শেখদের সাথেও এরকম ঘটনা ঘটেছে; এমনকি সৃষ্টির সেরা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথেও, তাঁর উপরেও কালো জাদু (ব্ল্যাক ম্যাজিক) করা হয়েছিল।
এই কারণেই আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) সূরা ফালাক নাজিল করেছেন কালো জাদু কাটানোর জন্য।
একবার নবীজির ﷺ বাড়ির এক সহকারী, যিনি তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন, কিছু কাপড় ও চুল সংগ্রহ করে তাঁর বিরোধীদের কাছে দিয়ে দেন। তারা সেগুলোর মাধ্যমে নবীর ﷺ উপর কালো জাদু করতে চেয়েছিল। যখন নবীজী ﷺ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন জিবরিল (আলাইহি’সালাম) এসে বললেন, "ইয়া রাসূল’আল্লাহ ﷺ, কূপের কাছে যান। সেখানে একটি কলস পাবেন। এর ভিতরে আপনার কাপড় ও চুল আছে, যেখানে তারা এগারোটা গিঁট বেঁধে রেখেছে।"
তুমি কি মনে করো আল্লাহ্র নবী ﷺ সেটা জানতেন না? অবশ্যই জানতেন, কিন্তু তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সমর্পণ করেছিলেন; নিজের ইচ্ছাকে প্রকাশ করেননি। আমরা আগে সাইয়িদিনা শাহ্ বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)-এর গল্পে উল্লেখ করেছি, যখন তিনি খরার সময় মানুষকে সাহায্য করেছিলেন আর ঐশী উপস্থিতি থেকে তাঁকে তিরস্কার করা হয়েছিল, “কেন আপনি আমার ইচ্ছার প্রতি সমর্পণ করলেন না?”
তখন সুরা ফালাক নাজিল হয় এবং নবীজী ﷺ গিঁটগুলোর উপর সুরা ফালাক পাঠ করেন। প্রতিটি গিঁট একে একে খুলে যেতে শুরু করল। যারা সিহর বা কালো জাদু থেকে মুক্তি চান, তাদের জন্য তাই eShaykh.com-এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, সূরা ফালাক ১১ বার পাঠ করবেন।
নবীজী ﷺ যখন এই আয়াত পাঠ করলেন, “ওয়া মিন শার্রি'ন-নাফফাসাতি ফিল উকাদ”
(“গিঁটে ফুঁ দেওয়া জাদুকরদের অনিষ্ট থেকে।”), তখন প্রতিটি গিঁট একে একে খুলে গেল এবং সেই সিহর সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে গেল।
তাই, তোমরা যদি আওলিয়ায়ে কিরামের অনুসরণ করতে চাও, তাহলে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করো - নিজেদেরকে সমর্পণ করো। এজন্য শেখ নিজেই সমর্পণ করেন, কিন্তু তার চারপাশের লোকেরা এই “সুযোগ” নেয় শেখদের সুনাম নষ্ট করার জন্য, এবং এটি অনেক শেখের ক্ষেত্রেই ঘটে। যারা এমন কাজ করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি পাবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এবং সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করুন।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) সেই ওলির এবং তাঁর মধ্যে থাকা সমস্ত পর্দা সরিয়ে দেবেন, যেমনটি তিনি সাইয়্যিদুনা আহমাদ আল-বাদাওয়ি (রহ.)-এর ক্ষেত্রে করেছিলেন। তাঁর চোখ এত বেশি নূরে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি একটি নিকাব পরতে বাধ্য হন, কারণ কেউ তাঁর চোখের দিকে তাকাতে পারত না। একই ঘটনা ঘটেছিল সাইয়িদিনা আবু ইয়াযিদ আল-বিস্তামি (রহ.)-এর সাথেও; কেউই তাকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে সক্ষম হয়নি।
La yas-hoo idhaa sahan-naas, oola’ika kalamuhum kalaamu ’l-anbiyaa.
“তারা ভুলে না যখন মানুষ ভুলে যায়। তারা নবী নয়, কিন্তু তারা সেই ব্যক্তিরা, যাদের আমি নবীদের মতো গঠন করেছি এবং আমি তাদের নবীদের পথের অনুসারী করব।”
“যখন তারা কিছু বলে, তা নবীদের অনুপ্রেরণার মতো হয়,” তাই তাদের কথা নবীসুলভ, তবে আল্লাহ তাদের নবী বানাননি, বরং তাদের বিভিন্ন নবীর গুণাবলীতে অলঙ্কৃত করেছেন।
Oola’ika ’l-abtaal al-abdaal haqqan.
তাঁরা সত্যিকারের বীর (আব্তাল) এবং তাঁরা এমন বিকল্প (আব্দাল) যাদেরকে আপনি সাহায্যের জন্য ডাকতে পারেন, কারণ ডাক দিলে তাঁরা সাড়া দেন।
Oolaa’ik alladheena idhaa aradatu bi ahl al-ardu uqoobatan aw adhaaban dhakartuhu wa saraftahu `anhum.
যদি আমি তাঁদের কারণে ইচ্ছা করি, তাহলে আমি মানবজাতির থেকে আমার শাস্তি সরিয়ে নেব। এবং যখন আমি শাস্তি দেওয়ার বা প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত করি, আর তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়, তখন আমি তাঁদের কারণে ক্ষমা করে দিই।
আল্লাহ আমাদের তাঁদের (আউলিয়া) সাথে রাখুন, যাঁরা আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত আছেন! আবু সুলায়মান আদ-দারানী (রহ.) বলেছেন, “যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নাম স্মরণ করে, ফেরেশতারা জান্নাতে একটি গাছ রোপণ করেন। যতবার কেউ ‘আল্লাহ’ বলে, ততবারই একটি গাছ রোপিত হয়।” তাই যদি আপনি দিনে ৫,০০০ বা ১০,০০০ বার ‘আল্লাহ’ বলেন, তবে জান্নাতে আপনার ১০,০০০ গাছ হবে। আর যেখানেই এই গাছ রোপিত হবে, তা আপনার জন্য নির্ধারিত হবে। দুটি গাছের মধ্যকার দূরত্ব হয়তো হবে এখান থেকে আসমান পর্যন্ত!
এই মহাবিশ্বে ছয় বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে, আর প্রতিটি গ্যালাক্সিতে ৮০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে! ওই গাছগুলোর প্রত্যেকটা এই মহাবিশ্বের চেয়েও বড় এবং এটি ভিন্ন ভিন্ন জান্নাতে থাকবে। আর এক একটা জান্নাতের আনন্দ অন্যটির চেয়ে ভিন্ন!
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন এবং বরকত দান করুন।
সাফল্য আসে শুধুই আল্লাহ্র কাছ থেকে, তাঁর হাবীবের ﷺ উসিলায়, সুরা ফাতিহার পবিত্রতার উসিলায়।
Wa min Allahi 't-tawfeeq, bi hurmati 'l-habeeb, bi hurmati 'l-Fatihah.
(১) প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাই, ইবন তাইমিয়া গাউস পাক সাইয়িদিয়া আব্দুল কাদির জিলানি (قَدَّسَ اللّٰهُ سِرَّهُ) -র কাছ থেকে ইজাজা (অনুমতি) প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর রচিত ‘আল ফতয়া আল-কুবরা’ গ্রন্থে তিনি প্রচুর আওলিয়া’আল্লাহর কথা উল্লেখ করেছেন আর তাঁদেরকে খাঁটি, পুণ্য, সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, যেমন, আবু ইয়াজিদ আল বিস্তামি, সিররি সাকাতি, সাইয়িদিনা আব্দুল কাদের জিলানী, রাবিয়া আল আদাওইয়া (রাবিয়া বসরি), এবং আরও অনেকে।
বলো, “আল্লাহ!”
জিকরুল্লাহর গুরুত্ব সিরিজ , পর্ব - ১২
মাওলানা শায়খ হিশাম কাব্বানী (ق)
৩০শে জুলাই, ২০১২, ফেন্টন জাউইয়া, মিশিগান।