Available in: English   Bengali   Go to media page

সাইয়্যেদিনা ইব্রাহিম ও সাইয়্যেদিনা ইসমাইলের কুরবানী

মাওলানা শায়খ হিশাম কাব্বানি · শুক্রবার/ঈদ খুতবা · বার্টন , MI USA · শুক্রবার, ডিসেম্বর 05, 2008

হজ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আরাফাত। যে আরাফাত পাবে না সে হজ্ব পাবে না। আল্লাহ্‌র নবী ﷺ এই দিনটিতে রোজার থাকার জন্য নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ্‌ নিজে বলছেন,

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا

এই দিনে আমি আপনার ধর্মকে পরিপূর্ণ করেছি, আপনার উপর আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করেছি, এবং আপনার ধর্ম হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছি। [সুরা মা'ঈদা ৫:৩]

আমি আপনার ধর্মকে নিখুঁত করে দিয়েছি এবং আপনার উপর আমার অনুগ্রহ অনবরত ঝরেই চলেছে বৃষ্টির মতো। সাহাবা কি সাংঘাতিক খুশি হয়েছিলেন, দীর্ঘ তেইশ বছর পর তারা বিজয়ী হয়েছিলেন ইবলিশের শক্তির বিরুদ্ধে; তাদের পক্ষে মক্কা বিজয় করা সম্ভব হয়েছিল যাতে করে তারা বছর বছর ফিরে ফিরে সেখানে যেতে পারেন হজ্বের হুকুম ও আহকাম সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে। সব্বাই ভীষণ খুশি ছিলেন, কেবল একজন ছাড়া। তাঁর নাম সাইয়িদিনা আবু বকর আস-সিদ্দিক رضي الله عنه। সিদ্দিক-উল-আকবর (রা) কাঁদছিলেন। সাহাবা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "ইয়া সিদ্দিক, আপনি কাঁদছেন কেন?" তিনি জবাবে বললেন, "মা বাআ'দা কামাল ইল্লা আন-নুকসান"। যখন তুমি সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে যাও সেখান থেকে অন্য কোথাও যাবার নেই নিচের দিকে নেমে যাওয়া ছাড়া। অর্থাৎ পূর্ণ চন্দ্র কেবল একটু একটু করে নিজের ক্ষয়ের দিকে যেতে থাকে।

কাজেই, ও মুসলিম, এই দিনটিতে রোজা থাকতে চেষ্টা কোরো। যদি কারো কোনো অজুহাত থাকে, শরীর খারাপ থাকে, তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যাদের পক্ষে রোজা থাকা সম্ভব, রোজা থেকো সেই নিয়তে, যাতে আল্লাহ্‌ তোমার গুনাহ গুলোকে ক্ষমা করে দেন।

এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দিনটিকে আরাফাহ্‌ বলা হয় কেননা এই দিনে আল্লাহ্‌ কোন কিছুকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কি সেই বিষয় যা তিনি স্পষ্ট করেছেন? এই সেই দিন যেদিন নবী ইব্রাহিমকে عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ স্পষ্ট করে বলেছিলেন তিনি যেন নিজের সন্তানকে কোরবানি করে দেন।

তাফসির-আন-নিসাবুরি সিরাতে আছে, বিবি হাজার বুঝতে পারছিলেন যে ইব্রাহিম (আ) -এর স্ত্রী বিবি সারার কিছু একটা সমস্যা আছে আর সেজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি সেখান থেকে চলে যাবেন। যাবার সময় তিনি একটা গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান। "ইয়া হাজার, আপনি কোথায় চললেন? আপনার তো সন্তান হতে চলেছে। আপনার কাছ থেকে একটি নয়, অনেক গুলো সন্তান জন্ম নেবে। কাজেই আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন, পালিয়ে যাবেন না"।

তিনি থেকে গেলেন আর সময় মতো তার গর্ভে আসলেন সাইয়িদিনা ইসমাইল (আ)। সেই সন্তান একটু একটু করে বড় হতে লাগলেন আর তার জন্য সাইয়িদিনা ইব্রাহিমের (আ) ভালবাসা কেবল বাড়তেই লাগল। একদিন একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে, আল্লাহ্‌ সুবহানাহুতা'আলা জিবরিল (আ) ফেরেশতাকে হুকুম করলেন, "ইয়া জিবরিল, যান, ইব্রাহিমকে বলে আসুন সে যেন আমার জন্য তার এই সন্তানকে কোরবাণী দেয়"। জিবরিল (আ) বললেন, "ইয়া রাব্বি, ইব্রাহিমের (আ) সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আর সেখানে আপনি এরকম একটা হুকুম নিয়ে আমাকে তার কাছে পাঠাচ্ছেন। কেমন করে এরকম একটা বাণী আমি তার কাছে পৌঁছে দেই? অবশ্যই আমি আপনার হুকুম তামিল করব, যদি কোনভাবে আপনি সরাসরি এই আদেশ তার কাছে পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে হয়ত আরও উত্তম হতো"। আল্লাহ্‌ রাহমানির রাহিম। জিবরিলের এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি হুকুম করলেন সরাসরি নবী ইব্রাহিমকে (আ) --

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। [সুরা সাফফাত - ৩৭:১০২]

একই স্বপ্ন ইব্রাহিম (আ) বারবার দেখতে থাকলেন। প্রথম বার এই স্বপ্ন দেখে ইব্রাহিম (আ) ১০০টি ভেড়া কোরবানি দিলেন। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র আন্তরিক বান্দা কোন কঠিন রোগে (ক্যান্সার, ইত্যাদি) জর্জরিত হলে ১০০টি ভেড়া কোরবানি করে, কি যার পক্ষে যতগুলো সম্ভব ভেড়া কোরবানি করে। (আজকাল তারা কোটি কোটি টাকা চিকিৎসার জন্য খরচ করে)। আমরা এরকম অসংখ্য নমুনা দেখেছি যখন আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করার ফলে তারা কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে।

ইব্রাহিম (আ) ১০০টি ভেড়া কোরবানি দেয়ার পরেও সেই স্বপ্ন আবারও দেখতে পেলেন, দুইবার, তিনবার সেই স্বপ্ন তার কাছে ফিরে ফিরে আসতে থাকল। তিনি বিবি হাজারকে বললেন ইসমাইল (আ) -এর মাথায় তেল মালিশ করে দিতে, কারণ তিনি তাকে নিয়ে বাইরে যাবেন। বিবি হাজার জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেকে নিয়ে তিনি কোথায় চললেন? "আল্লাহ্‌ আমাকে হুকুম করেছেন ইসমাইলকে কোরবানি করার জন্য"। তিনি নিজের সন্তানের দিকে তাকালেন, নিজের স্বামীর দিকে তাকালেন, আর বললেন, "আল্লাহ্‌ যদি আপনাকে হুকুম করেই থাকেন তাহলে সেই হুকুম পালন করুন"। ইব্রাহিম (আ) নিজের সন্তানকে বললেন, এসো, আমরা আজকে পাহাড়ে যাই, আর সেখানে গিয়ে লুকোচুরি খেলি, কাপড় দিয়ে আমি তোমার চোখ ঢেকে দেব"।

ইসমাইল (আ) বললেন, "ও আমার বাবা, কেন বিনা কারণে আপনি আমার সাথে সময়ের অপচয় করে চলেছেন? আপনাকে যা হুকুম করা হয়েছে, আপনি সেটাই করুন। আমি তো ভীত নই। আল্লাহ্‌ চান যে আপনি আমাকে কোরবানি করবেন, কাজেই তাঁর হুকুম শিরোধার্য। ও আমার পিতা, কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরুন, আপনার মেজাজ ঠাণ্ডা রাখুন। আমাকে নিয়ে যান, কোরবানি করুন। কেবল আমার গায়ের এই জামাটাতে রক্ত লেগে যাবার আগেই সেটা খুলে নেবেন আর বাসায় গিয়ে আমার মা'কে সেই জামাটা দেবেন, যাতে ওই জামাটা দেখে তিনি আমার কথা মনে করতে পারেন। মা'কে বলবেন, "আমি আমাদের সন্তানকে তাঁর কাছে রেখে এসেছি যিনি কিনা সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি আমাদের সন্তানকে রেখে এসেছি আল্লাহ্‌র কাছে"।

ইব্রাহিম (আ) বললেন, "ইয়া রব, আমাকে দয়া করুন"। সিরাতে আছে, সেই সময় নবী ইসমাইলের (আ) বয়স ছিল মাত্র সাত অথবা নয় বছর। ফেরেশতারা কাঁদতে শুরু করে দিলেন। বেহেশতের দরজাগুলো নিজে থেকে খুলে খুলে যেতে লাগল। যেই মুহূর্তে ইব্রাহিম (আ) সেই ধারালো ছুরিখানা তার প্রিয় সন্তানের গলায় ধরলেন, কিছু বর্ণনায় আছে, ইসমাইল (আ) পোড়া মাংসের ঘ্রাণ পেলেন। তিনি বললেন, "ও আমার পিতা, ঘটনা কি? আমি তো পোড়া মাংসের ঘ্রাণ পাচ্ছি?" ইব্রাহিম (আ) বললেন, "ও আমার সন্তান, তুমি ঠিকই ঘ্রাণ পাচ্ছো, আমার কলিজাটা পুড়ে ছারখার হয়ে গেছেরে বাবা"।

ও মুসলিম, দ্যাখো, কিভাবে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সব কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন অথচ আমাদের অভিযোগ এক মুহূর্তের জন্যেও থেমে থাকে না। আল্লাহ্‌ জিবরিল (আ) ফেরেশতাকে হুকুম করলেন, "ইয়া জিবরিল, জলদি যান, ছুরিকে থামিয়ে দেন। ছুরি যদি থামাতে না পারেন আমি আপনাকে আমার ঐশী নৈকট্য থেকে সরিয়ে দেব"। জিবরিল (আ) ছুরিকে হুকুম করলেন থেমে যেতে। প্রচণ্ড ধারালো ছুরি বারবার ইসমাইলের (আ) গলায় চালাবার পরেও গলা এতটুকুও কাটল না। বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে গেলেন ইব্রাহিম (আ)। তার কাছে মনে হতে লাগল, আল্লাহ্‌র আদেশ পালনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আল্লাহ্‌ এই কথা তার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিলেন, কিভাবে তিনি জিবরিল (আ) ফেরেশতাকে বলেছিলেন, ছুরি যেন তার ধার হারিয়ে ফেলে। ছুরি নিজেই ইব্রাহিম (আ) -কে জিজ্ঞেস করল, 'ইয়া ইব্রাহিম (আ) খলিলুল্লাহ, আপনি রাগান্বিত কেন?" ইব্রাহিম (আ) জবাব দিলেন, "কারণ আল্লাহ্‌ তোমাকে যা করতে বলেছিলেন তুমি সেটা করোনি, তাই"। ছুরি তখন বলে উঠল, "ইয়া ইব্রাহিম (আ), আমার উপর যদি আপনার রাগ হয়েই থাকে, নিমরুদের আগুনের উপরে তাহলে কেন রাগ হলেন না যখন সেই আগুন আপনাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল না?" ইব্রাহিম (আ) জবাব দিলেন, "কারণ আল্লাহ্‌ নিজেই সেই আগুনকে হুকুম করেছিলেন আমার উপরে শীতল হয়ে যেতে, আমি যেন পুড়ে না যাই, তাই"। ছুরি তখন জবাব দিল, "এবং সেই একই আল্লাহ্‌ আমাকে হুকুম করেছেন, আমি যেন আপনার পুত্রের গলা না কাটি"। ছুরি বলল, "আপনি ইসমাইলের (আ) গলায় পোচ দিচ্ছেন আর ওদিকে ৭০ বার জিবরিল (আ) ফেরেশতা আমাকে নিষেধ করেছেন, আমি যেন আমার ধার হারিয়ে ফেলি"।

এরপর আল্লাহ্‌তা'আলা ইব্রাহিম (আ) -কে হুকুম করলেন, ইসমাইলের (আ) পরিবর্তে একটা ভেড়া কোরবানি দিতে (জানের বদলে জান)। নবী ইসমাইল (আ) তখন তার পিতা নবী ইব্রাহিম (আ) -কে বললেন, "ও আমার পিতা, আমি আপনার কাছে একটি প্রশ্ন করতে চাই। কে বেশি উদার, আপনি নাকি আমি?" ইব্রাহিম (আ) জবাবে বললেন, "আমি তো আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির নিয়তে আমার পুত্রকে কোরবান করে দিয়েছিলাম"। ইসমাইল (আ) বললেন, "ও আমার পিতা, আল্লাহ্‌র হাবীব সাইয়িদিনা মুহাম্মাদের ﷺ আলো বহন করে চলেছে যেই ইসমাইল (আ), কেমন করেই বা সে এভাবে মৃত্যু বরণ করবে?"

(মওলানা শেখ হিশাম কাব্বানি বলছেন) -

এটা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে ইব্রাহিমের (আ) জন্য পরীক্ষা, আমাদের সবার জন্যেই পরীক্ষা। আল্লাহ্‌র রসুলের ﷺ জন্য আমরা কি নিজেদেরকে কোরবান করে দিতে পারব নাকি না? আমরা কি তাঁর সুন্নিয়তকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারব নাকি না? আমরা কি তাঁকে মান্য করতে পারব নাকি না?

তখন সাইয়িদিনা ইসমাইল (আ) বললেন, "না, আমি উত্তম, কেননা আপনি উদার অবশ্যই, কিন্তু আমি আমার আত্মাকে কোরবানি করে দিয়েছি ইতিমধ্যেই"। আনা তাকরামতু রুহি। আপনি তো কোরবান করছেন আমাকে। আর আমি কোরবানি করে দিয়েছি আমার নিজেকে, আমার আত্মাকে। আল্লাহ্‌র হাবীবের ﷺ সমস্ত উম্মতের জন্য নবী ইসমাইল (আ) নিজেকে কোরবান করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র রসুলের ﷺ গোপন রহস্য বহন করে চলেছেন তিনি।

আর এভাবেই আরাফাতের দিন প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ, এটা সেই মহান আত্মত্যাগের দিন। কাজেই এসো, আমরা এই দিনটাতে রোজা থাকার নিয়ত করি, এবং আল্লাহ্‌কে বলি,

"ইয়া রাব্বি, আপনার পেয়ারি হাবীব সাইয়িদিনা মুহাম্মাদের ﷺ উসিলায়, নবী ইব্রাহিমের (আ) উসিলায়, নবী ইসমাইলের (আ) উসিলায়, যত হাজ্জি আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সবার উসিলায়, আমাদের পাপের খাতাগুলোকে আপনি আপনার ক্ষমা দিয়ে ধুয়ে সাফ করে দিন। তাদের হজ্বের বরকত আমাদের খাতায় লিখে দেন, যারা হজ্বে গেছে আমাদের নামগুলোকেও তাদের সাথে অন্তর্ভুক্ত করে দেন, আর সেভাবে বছর বছর প্রতিটি হজ্বে লিখে দেন, আপনার হাবীবের ﷺ হজ্বের সাথে আমাদের হিসাবকে মিলিয়ে দেন, ইয়া মাবুদ-এ-ইলাহি"।

নবী ইব্রাহিম (আ) এবং নবী ইসমাইলের (আ) আত্মত্যাগের নিগুঢ় রহস্য

মওলানা শেখ মুহাম্মাদ হিশাম কাব্বানি

মিশিগান, ডিসেম্বর ৫, ২০০৮

UA-984942-2