Available in: English   Bengali   Go to media page

মাকাম-উল-ইখলাস, আন্তরিকতার মাকাম

মওলানা শেখ হিশাম কাব্বানি

সেপ্টেম্বর ৫, ২০১০, মিশিগান

ফজর, রমজান সিরিজ

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদ, অয়া আলা আলিহ অয়া সাহবিহি সাইয়িদিনা মুহাম্মাদ।

সবাই জোরে বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুন রাসুল'আল্লাহ

আউজু বিল্লাহি মিন আশ-শায়তানি র-রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানি র-রাহিম

নাওয়াইতু 'ল-আরবাইন নাওয়াইতু 'ল-ইতিকাফ, নাওয়াইতু 'ল-খালওয়া, নাওয়াইতু 'ল-উজলা, নাওয়াইতু 'র-রিয়াদাহ, নাওয়াইতু 'স-সুলুক, লিল্লাহি তা'আলা ফি হাদা 'ল-মাসজিদ

নাওয়াইনা 'স-সিয়াম, ইনশা'আল্লাহ

আতি উল্লাহ ওয়া আতি'উ 'র-রাসুল ওয়া উলি'ল-আমরি মিনকুম

আল্লাহ্‌কে মান্য করো, রসুলকে মান্য করো এবং মান্য করো তাদেরকে যাদের উপরে তোমাদের কতৃত্ব অর্পণ করা হয়েছে। [সুরা নিসা ৪:৫৯]

আমরা এর আগে বলেছি, কিভাবে যেই হৃদয়ে আল্লাহ্‌র ওয়াহদানিয়ার ঘোষণা বারবার উদ্ভাসিত হতে থাকে, অর্থাৎ যেই কলবের অবস্থান মাকাম-উত-তৌহিদে সেই হৃদয়ের শয়তান ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর যে কিনা সব সময় নিজেকে আল্লাহ্‌র সাথে শরিক করে ফেলে, যদি সামান্যতম ভালো কাজও সে করে থাকে, সে বলে বেড়ায়, "জানো? আমি না এটা করেছি, টাকা দিয়েছি, পাকিস্তানের জন্য ত্রাণ দিয়েছি"। শুনে মনে হয় পাকিস্তান যেন সমস্ত বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, সন্ত্রাস, দুর্যোগ, বিশৃঙ্খলা। আমি জানি না পাকিস্তানে কি হয়ে চলেছে। হয়ত খুব বেশি মুশরিক সেখানে আছে। অনেক বেশি লোক আল্লাহ্‌র নামে মানুষকে নিজেদের দিকে ডেকে চলেছে। আর কালা যাদু, আজ পর্যন্ত আমি একজন পাকিস্তানিকে দেখিনি যাকে কালা যাদুতে ধরেনি। ঠিক যেমন, কেনিয়া, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া - এই সমস্ত দেশে কালা যাদুর ছড়াছড়ি। আল্লাহ্‌ যেন ওই সমস্ত কালা যাদু তুলে নেন। ওরা যখন আরেকজন মানুষের উপরে এই কালা যাদু প্রয়োগ করে সেটার কোন কার্যকারিতা থাকে না। তোমরা কি জানো কালা যাদু আসলে কি? যখন শয়তান তোমাকে মাকাম-উত-তৌহিদে পৌঁছে যাওয়া থেকে বাধা দিতে থাকে। কাজেই যাকে তৌহিদ থেকে বাধা দেয়া হচ্ছে শয়তান তাকে ক্লান্ত করে ছেড়ে দেবে। কাজেই এখান থেকে বেঁচে ওঠার জন্য তোমার কি প্রয়োজন? ইখলাস - আন্তরিকতা। যার আন্তরিকতা আছে শয়তানকে সে তার হৃদয় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আর এই আন্তরিকতা তুমি কেমন করে অর্জন করবে তাহলে?

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ

ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু ইত্তাকুল্লাহ ওয়া কুনু মা'আস-সাদিকিন

ও তোমরা যারা বিশ্বাস প্রাপ্ত হয়েছ, আল্লাহ্‌কে ভয় করো আর তাদের সাথে সাথে থাকো যারা পুণ্যবান (কথায় এবং কাজে)। [সুরা তাওবাহ ৯:১১৯]

আল্লাহ্‌ বলছেন তাঁকে ভয় করতে, মুত্তাকি হতে, তাকওয়া অর্জন করতে, নইলে তুমি কেবলই সময়ের অপচয় করে চলেছ। 'তাকওয়া' মানেই আন্তরিকতা। যার তাকওয়া আছে আল্লাহ্‌ তাকে পুণ্যবান মানুষের সাথে থাকতে দেন, তারা তাকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। কাজেই এই পুণ্যবান মানুষগুলোর সাথে থেকো, যারা আল্লাহ্‌র সাথে তাদের শপথ রক্ষা করেছেন এবং কখনোই পাল্টে যায়নি।

সুতরাং তাকওয়া মানে আল্লাহ্‌র ভয়ে সুদৃঢ় থাকা, আর আমরা সবাই সেটা নিয়েই সংগ্রাম করে চলেছি। কেমন করে এই ইখলাস অর্জন করতে হয়? পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ্‌ সুরা ইখলাস প্রেরণ করেছেন, যার শুরু হয় 'কুল হুওয়া আল্লাহু আহাদ' দিয়ে। তুমি ইখলাস অর্জন করতে চাও? তাহলে ইখলাস শরীফ তেলাওয়াত করতে থাকো। সেজন্যই আল্লাহ্‌র অলিরা তাদের অনুসারীদেরকে দৈনিক ১০০ বার থেকে শুরু ১০০০ বার পর্যন্ত সুরা ইখলাস পড়তে নির্দেশ দেন। কেউ যখন কোন সমস্যা নিয়ে আসে, আর আমি তাকে বলি "ইয়া ফাত্তাহ পড়বে ১০০ বার", ওরা জিজ্ঞেস করে, 'প্রতিদিন?' মানে কি? তুমি কি চাও? মাসে একবার পড়তে চাও? বছরে একবার? এটা তাদের জন্য ভয়ঙ্কর কঠিন কাজ। আমরা দারুণ ব্যস্ত। কি নিয়ে? দুনিয়াদারি নিয়ে।

কাজেই সুরা ইখলাস পড়ো। সেটা তোমার উপর প্রতিভাসিত হতে থাকবে। তুমি আল্লাহ্‌র দিকে এগিয়ে চলেছ সুরা ইখলাস পড়তে পড়তে - আর তোমার কি মনে হয় যে আল্লাহ্‌ তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন? তোমার বাসার দরজায় কেউ এসে কড়া নাড়ছে আর তুমি বলছ, না, দরজা আমি খুলবই না। সেই মানুষটা যদি হাল না ছাড়ে, কড়া নাড়তেই থাকে - শেষমেশ দরজা তোমাকে খুলতেই হবে। দরজা খুলে হয় তুমি তার উপরে রেগে চিৎকার করতে থাকবে আর না হলে সুন্দর করে তাকে ভেতরে নিয়ে আসবে। আল্লাহ্‌ আমাদের মতো নন। আল্লাহ্‌র দরজা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত। আর যদি তুমি সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাও, বেরিয়ে যাবার দরজা খুঁজে পাওয়া ভীষণই কঠিন - সুঁইয়ের মাথায় ছিদ্র খুঁজে পাওয়া যতটা কঠিন তার চেয়েও বেশি কঠিন সেই কাজ। কাজেই এভাবে সুরা ইখলাস যারা প্রতিদিন নিয়মিত পড়ে, আল্লাহ্‌ তাদের উপরে সুরা ইখলাসের বরকত ঢেলে দিতে থাকেন।

শয়তানের কাজ আমাদেরকে সুরা ইখলাস থেকে ভুলিয়ে রাখা। তুমি যখন কোন প্রচণ্ড ধনী লোকের কাছে যাও, প্রেসিডেন্ট অথবা রাজা, তারা তোমাকে মেডেল দেয়, নিজেদের বদান্যতার প্রদর্শনী করে। দ্বিতীয় বার যখন তুমি সেই একই রাজার কাছে যাও তিনি তোমাকে আরেকটা মেডেল দেন। তুমি যদি নিজে থেকে তৃতীয় বার সেই একই লোকের কাছে যেতে চাও, তিনি হয়ত তৃতীয়বার তোমাকে দাওয়াতই করবেন না আর (মওলানা হাসছেন)। অথচ দ্যাখো, যখন তুমি আল্লাহ্‌র রসুলের ﷺ উপরে সালাওয়াত প্রেরণ করো, তিনি তোমার সালামের জবাব দেন আরও উত্তম একটা সালামের সাথে। যে কেউ নবীর ﷺ উপরে একবার সালাম দেয়, আল্লাহ্‌ নিজে সেই মানুষের উপরে দশবার সালাম পাঠিয়ে দেন। কোথায় সেই মানুষের সালাম আর কোথায় আল্লাহ্‌র সালাম! কোন তুলনা হতে পারে? আল্লাহ্‌র সালামের তো কোন বর্ণনাই নাই, হতে পারে না, অকল্পনীয়, অবর্ণনীয়, অতুলনীয় সেটা।

সাহাবারা (রাদি'আল্লাহু আনহু) নবীর ﷺ পাশ দিয়ে যাবার সময় বলতেন, "আস-সালামু আলাইক ইয়া রাসুল'আল্লাহ"। উনি জবাব দিতেন, "ওয়ালাইকুম আস-সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ইয়া আবদ'আল্লাহ!" আর তারপর ওই একই সাহাবা (রা) যখন আবার নবীর ﷺ পাশ দিয়ে যেতেন, তখন ইচ্ছা করে আবারও তারা আল্লাহ্‌র রসুলকে ﷺ সালাম দিতেন, তাঁর কাছ থেকে আরেকটা সালামের জবাব পাবার উদ্দেশ্যে। সাহাবাদের আন্তরিকতা - ইখলাস প্রদর্শনের পন্থাই ছিল নবীকে ﷺ সালাম প্রেরণ করা। এবং আমরাও এই দূর থেকে আল্লাহ্‌র হাবীবের ﷺ প্রতি সালাম প্রেরণ করছি, "আস-সালাতু ওয়া'স-সালামু আলাইক, ইয়া রাসুল'আল্লাহ ﷺ! তোমাদের কি মনে হয়? নবীজি ﷺ কি সালামের জবাব দিচ্ছেন না? নিঃসন্দেহে, অবশ্যই তিনি দিচ্ছেন। এখানে মনে করো ১০০ জন মানুষ এই মুহূর্তে আছে। ১০০ কে দশ দিয়ে গুণ করলে হলো ১০০০, এক সালাম থেকে প্রত্যেকে ১০০০ হাসানাত প্রাপ্ত হচ্ছে। আর যদি এখানে ৫০০০ মানুষ থাকত, তাহলে প্রত্যেকে পেত ৫০,০০০ হাসানাত। তুমি যদি এভাবে হাসানাত পেতে চাও, তাহলে ইন্দোনেশিয়া চলে যাও। সেখানে এক একটা মসজিদে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষ নামাজ পড়তে আসে।

কাজেই যে কেউ যে কিনা ইখলাস আন্তরিকতার সাথে আসে, কুল হুআ আল্লাহু আহাদ, দরজা খুলে যায়। ইখলাস হলো সমস্ত কথার এবং কাজের বীজ। আর এটাই ইখলাসের মূল গোপন রহস্য। ফলের যেমন খোলস থাকে, তেমনি তোমাদের সব কথা এবং কাজের মুলে আছে ইখলাস। তুমি যে ভাবে কথা বলো, যে ভাবে কোন কাজ করো তার ভেতর দিয়েই তোমার ইখলাস, তোমার আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। যদি তোমার কথা পরিশিলীত হয়, সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারো - সেটা তোমার আন্তরিকতার লক্ষণ। যাকে তুমি পছন্দ করো না তার সাথে ধৈর্য ধরাটাই ইখলাস। তার চোখে চোখ রাখাটাও তোমার জন্য কঠিন, অথচ তুমি তার সাথে পাশাপাশি বসে হেসে হেসে কথা বলে চলেছ, সেটা তোমার ইখলাসের পরিচয়, কেননা তোমার মতো সেও তো আল্লাহ্‌রই বান্দা। আল্লাহ্‌ নিজেই তাকে পাঠিয়েছেন তোমার জন্য পরীক্ষা হিসেবে। আল্লাহ্‌ দেখতে চান তুমি তাকে কিভাবে সামাল দাও।

কাজেই ফল যেমন করে তার খোলসের ভেতরে থাকে, তোমার কথা আর কাজের ভেতরে থাকে তোমার আন্তরিকতা। ফলের পরিচয় মিলে যায় তার খোলসের গায়ে। ফল যদি পচে গিয়ে থাকে, খোলসেও পচন ধরতে বাধ্য। কাজেই তোমার কথা আর কাজকে অনেক উঁচু স্তরের হতে হবে। তুমি যখন ওই প্রচণ্ড ধনী, প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী, রাজা বাদশাহ্‌র সাথে দেখা করতে যাও, তুমি তাদের সাথে কিভাবে কথা বলো? যাচ্ছেতাই ভাবে, নাকি অনেক ভেবে চিন্তে, ধীরে সুস্থে, আদবের সাথে? কারণ তুমি চাও তোমার কথায় তারা যাতে তোমার দিকে আকৃষ্ট হন। তাহলে তুমি আল্লাহ্‌ আর তাঁর রসুলের ﷺ সাথে কিভাবে কথা বলো? নবীজির ﷺ উচ্চারিত হবার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ানো খুবই জরুরী (অটোমানরা ঠিক সেটাই করতেন)। এখানে আমরা বারবার উঠে দাঁড়াব আর বসতে থাকব। কিন্তু মানুষ তো সেটার সাথে অভ্যস্ত নয়। কাজেই তোমার হৃদয় থেকে অন্তত উঠে দাঁড়িও। মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা, সমস্যাটা আসলে ঠিক কি? এই মানুষগুলো বারবার ওঠে আর বসে কেন?" আমি তাদেরকে কি জবাব দেব (যা কিনা তারা বুঝতে পারবে?)। কাজেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো।

ইখলাস - আন্তরিকতা যদি ভেতরের ফল হয়েই থাকে তাহলে যার ভেতরে সেই ফল নাই - তার ভেতরে কি আছে? না, তুমি সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও না, এটা বুঝে ওঠা খুবই জরুরী। সেই শূন্য খোলসটাকে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তোমার পচা কথা আর বাজে কাজগুলোকে পুড়িয়ে ফ্যালো। শাস্তির উদ্দেশ্যই পরিষ্কার করা এবং দোজখের আগুন শূন্য খোলসটাকে পুড়িয়ে বীজটাকে পুণ্য করে তোলে।

ও যারা মু'মিন, বিশ্বাসী, মুওয়াহিদ, যারা কিনা আল্লাহ্‌র একত্ববাদে বিশ্বাস করো,

আল্লাহ্‌ তাঁর পবিত্র কোরআনে বলছেন,

رَبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلًا

রাব্বুল মাশরিকি অয়াল-মাগরিবি, লা ইলাহা ইল্লা হু'ওয়া ফাত্তাখিজু অয়াকিলা

তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের অধিকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব, তাঁকেই গ্রহণ করুন কর্মবিধায়করূপে। [সুরা মুযযাম্মিল - ৭৩:৯]

সাবধান, তিনি পূব আর পশ্চিমের স্রষ্টা, কিন্তু এখানে একটা বিশেষ অর্থ আছে। হ্যা, তিনি সূর্যোদয়ের প্রারম্ভের স্রষ্টা, শাওয়ারিক-আল-আনওয়ার। তিনি উভয় আলোরই স্রষ্টা, যেই আলো উদিত হয় আবার যেই আলো অস্তমিত হয়। কিন্তু একদম সাথে সাথে তিনি তোমার মনোযোগ আকৃষ্ট করছেন লা ইলাহা ইল্লা হুওয়া। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থ আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। লা ইলাহা ইল্লা হুওয়া অর্থ অজানা নির্যাস ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। এটাই ইসম'আদ'জাত, যেটা কিনা আল্লাহ্‌র পূর্বে কুল হুওয়া, অর্থাৎ নিগুঢ় অজানা। অর্থাৎ তিনি পূব এবং পশ্চিমের রব, এমনকি যদি পূবের আলো উদয় হয় এবং পশ্চিমের আলো অস্ত চলেও যায় - তারপরেও তাঁর নির্যাস তাঁর স্বত্বা অজানাই রয়ে যাবে।

এবং আল্লাহ্‌ বলছেন,

رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ

রাব্বুল মাশরিকায়নি অয়া রাব্বুল মাগরিবায়নি, ফা বি আইয়ি আলাইয়ি রাব্বিকুম তুকাজজিবান

তিনি দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের মালিক। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? [সুরা আর-রহমান - ৫৫:১৮]

"তিনি দুই পূর্ব এবং দুই পশ্চিমের রব"। তুমি আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা কথা কেন বলে চলেছ? পূব দিক কি একটার বেশি আছে? পশ্চিম কি একাধিক আছে? একের বেশি সূর্য আছে? নিশ্চয়ই আছে, না হলে তো আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে এই কথা বলতেন না। রাব্বুল মাশারিক, ওয়া রাব্বুল মাগারিব, "তিনি সবগুলো পূব দিকের রব, তিনি সবগুলো পশ্চিম দিকের রব"। পূবের কোন শেষ নাই, প্রতি মুহূর্তে তিনি আরও বেশি বেশি পূব সৃষ্টি করেই চলেছেন। কাজেই পূব এবং পশ্চিমের সংখ্যা অসীম। যারা কিনা সিনিয়র মুরিদ, আল্লাহ্‌র অলিরা তাদেরকে নির্দেশ দেন, দৈনিক আওরাদে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তো আছেই, তার সাথে সাথে লা ইলাহা ইল্লাহুওয়া পড়ার জন্যে, দৈনিক ১০০ বার থেকে ১০০০ বার। আর এই কারণেই বায়াতের সময় আমরা "আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু হাক্ক" পড়ি, যেন আমরা এই অজানা 'হুওয়া'-র সাগরে প্রবেশ করতে পারি।

যখন আল্লাহ্‌ বলছেন, রাব্বুল মাশরিক, ওয়া রাব্বুল মাগরিব, পূব এবং পশ্চিমের রব, সেটার অর্থ কি? "আল্লাহু নুর-উস-সামাওয়াতি ওয়াল-আরদ, উদিয়মান সূর্য যার দীপ্তি অন্য সব কিছুকে অতিক্রম করে যায়। সেজন্যই এর আগের সোহবতে আমরা শাওয়ারিক আল-আনওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, যখন কিনা তুমি এই সমস্ত পর্দা আর ধুলা ছুঁড়ে ফেলে দাও যা তোমাকে আলো থেকে আড়াল করে রাখে। তাঁর কাছে আসো, সাথে করে কোন কিচ্ছুই নিয়ে আসতে পারবে না। কেবল মাত্র তখনই এই উদিয়মান আলো তোমার ভেতরে গৃহীত হবে, তোমার হৃদয়ের ভেতরে প্রতিভাসিত হতে থাকবে সেই নূর!

কে তিনি, যার ভেতরে কিনা সমস্ত নাম এবং সমস্ত আলো উদ্ভাসিত হতে থাকে? তিনিই আল্লাহ্‌র রসুল ﷺ, তিনিই মাশরিক (পূব) এবং তিনিই মাগরিব (পশ্চিম) যিনি কিনা প্রতি মুহূর্তে উদিত হয়েই চলেছেন। এবং তাঁরই ভেতরে আল্লাহ্‌র সমস্ত নামের এবং আলোর তাজাল্লি জাজ্বল্যমান হয়ে চলেছে। তাঁর অনেক নামের একটি আল-মাশরিক এবং অপরটি আল-মাগরিব। খেয়াল করো, আল্লাহ্‌ বলেছেন, রাব্বু 'ল-মাশরিক, পূবের রব, যেখান থেকে সমস্ত উদীয়মান আলো আসে। আর এটাই সেই অর্থ যে, আল্লাহ্‌ হলেন সেই অজানা রব এবং নিজের নামের সাথে সাথে তিনি নবীর ﷺ নামকে সমুন্নত করেই চলেছেন।

তাহলে রাব্বু 'ল-মাশরিকায়িন ওয়া 'ল-মাগরিবায়িন এটার অর্থ কি হবে? এর ভেতরে কোন শরিক নাই, আল্লাহ্‌র সাথে কোন অংশীদারিত্ব নাই। তিনি নবীর ﷺ রব, যিনি কিনা সুলতান-উল-আন্‌বিয়া এবং সুলতান-উল-আউলিয়া। অর্থাৎ সেটা হলো সেই অলির পরিচয় যিনি কিনা সেই নবীর ﷺ কাছ থেকে সরাসরি সেই সমস্ত তাজাল্লিয়ত গ্রহণ করে চলেছেন এবং সেটার মাধ্যমে উম্মতকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে যাচ্ছেন। এটা আরেকটা ইঙ্গিত যে কিভাবে আল্লাহ্‌ তাঁর হাবীবকে ﷺ দিতে থাকেন, যিনি কিনা সুলতান-উল-আউলিয়া। ফা বি আইয়ি আলাইয়ি রাব্বিকুম তুকাজজিবান। কাজেই কে তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন যে তুমি বলবে যে আল্লাহ্‌র অলি বলে কিছু নাই? কোন দুঃসাহসে? না। তিনি আল-মাশরিকায়িন এবং তিনি আল-মাগরিবায়িন।

মহিউদ্দিন ইবন আল-আরাবি قَدَّسَ اللّٰهُ سِرَّهُ বলেন, "সুলতান-উল-আউলিয়া সবসময় নবীর ﷺ দিকে ফিরে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর কাছ থেকে সরাসরি গ্রহণ করবেন বলে"। পূব এবং পশ্চিমের স্রষ্টার জন্য তাহলে কি? অর্থাৎ যতগুলো আউলিয়া তিনি নবীকে ﷺ দিয়েছেন তাদের সবার রব তিনি - আল্লাহ্‌ সুবহানাহুতা'আলা। তাঁরাই শাওয়ারিক-আল-আনওয়ার, স্পটলাইটের মতো উজ্জ্বল হয়ে পুরো বিশ্বজগতের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ান তাঁরা, যাদের কাজ হলো ইখলাসের শাঁসকে নিয়ে এসে মুরিদের হৃদয়ের ভেতরে বপন করে দেয়া। যে আন্তরিকতার সেই নির্যাসকে বহন করে বেড়ায় সে নিজেই তখন আয়াত মিন আয়াতুল্লাহ, আল্লাহ্‌র অনেক নিদর্শনের একটি নিদর্শনে পরিণত হয়ে যায়।

আমাদের গ্র্যান্ডশেখ শেখ শরাফুদ্দিন আদ'দাগেস্তানির ق অনেক নামের একটি ছিল 'আয়াতুন মিন আয়াতুল্লাহ তামশি 'আলা আল-'আরদ"। কেউ যখন এই সমুদ্রগুলো প্রবেশ করে, সে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, "আমি এখানে কি করছি"? বেশির ভাগ আউলিয়া সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করে আছে, যখন কিনা আল্লাহ্‌ তাদেরকে আল্লাহ্‌র ঐশী উপস্থিতিতে ডেকে নিয়ে পাঠাবেন। আমরা যখন জেনেই ফেলেছি যে আল্লাহ্‌ তাঁর হাবীবকে ﷺ বলছেন, মাশরিক ওয়া মাগরিব, মাশরিকায়িন ওয়া মাগরিবায়িন, মাশারিক ওয়া মাগারিব, তখন আমরা এটাও জেনে ফেলেছি যে ইখলাস প্রাপ্ত হওয়া অর্থাৎ মাখালিস হয়ে উঠতে হলে সেটা কেবল মাত্র নবীর ﷺ মাধ্যমেই সম্ভব। কাজেই আমাদেরকে সেই দরজায় বারবার কড়া নেড়ে যেতে হবে, "ইয়া সাইয়িদি, ইয়া রাসুল'আল্লাহ ﷺ!" কিন্তু তুমি যদি একা আসো, তোমার জন্য তারা দরজা খুলবেন না, কারণ তোমার ভেতরে সেই ইখলাস এখনও আসেনি, তুমি এখনও আন্তরিকতা-শূন্য। এমন একজনকে তোমার সাথে করে নিয়ে আসতে হবে যে কিনা উসিলা, তোমার মাধ্যম, তোমার বাহন। নিঃসন্দেহে তোমার শেখের প্রবেশাধিকার তোমার চেয়ে বেশি। যখন তিনি বলেন, "আস-সালামু 'আলাইক ইয়া সাইয়িদি, ইয়া রাসুল'আল্লাহ ﷺ!" নিঃসন্দেহে সেটা আমাদের বলার চাইতে আলাদা। তাঁর বলার ভেতরে ইখলাস আছে, আন্তরিকতা আছে। তাই তখন তারা দরজাটা খুলে ধরেন। যার ভেতরে আন্তরিকতা নাই, সে তার ডাক দেয়ার জন্য পুরস্কৃত হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু দরজা খুলবে না। কাজেই প্রতিদিন চেষ্টা করতে থাকো, প্রতিদিন বলতে থাকো। নবীর ﷺ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকতে থাকো, ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিও না, কড়া নেড়েই যাও।

আল্লাহ্‌ বলছেন,

وَأْتُوا۟ ٱلْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَٰبِهَا

অয়া'তুল বুয়ুতা মিন আবওয়া বিহা

বাড়িতে প্রবেশ করো যথার্থ দরজা দিয়ে [সুরা বাকারা ২:১৮৯]

কারা এই দরজা? তারাই আউলিয়া'আল্লাহ। যেভাবে নবী ﷺ বলছেন,

انا مدينة العلم و علي بابها

আনা মাদিনাতুল-'ইলমি ওয়া 'আলিয়ুন বাআবুহা

আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তাঁর দরজা।

সাইয়িদিনা আলী, কারাম'আল্লাহু অয়াজ'হা, আলায়হি'সালাম, রাদি'আল্লাহু আনহু, সেই শহরের দরজা। এবং সকল যুগে সাইয়িদিনা আলীর (রা) একজন উত্তরাধিকারি রয়েছেন। কাজেই তাঁকে সাথে করে আসো এবং তখনই তুমি সেই শহরে প্রবেশ করতে পারবে। হিজরতের সময়ে আল্লাহ্‌র রসুল ﷺ কাকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন? সাইয়িদিনা আবু বকর আস-সিদ্দিক رضي الله عنه। এমন একটা মুহূর্তও ছিল না যে সিদ্দিক-উল-আকবর (রা) নবীর ﷺ কাছ থেকে দূরে ছিলেন। কাজেই সেই শহরের ভেতরেই তিনি আছেন, বাইরে নয়। ভেতরে তুমি আরেকটা দরজা খুঁজে পাবে যার ভেতর দিয়ে তোমাকে প্রবেশ করতে হবে, নিশ্চিত হবার জন্য যে তুমি নবীর ﷺ উপস্থিতিতে পৌঁছে গেছ। আর সেজন্যই নকশবন্দী তরিকাকে গোল্ডেন চেইন (সোনালি সিলসিলা) বলা হয়, কেননা এখানে এমন দুইজন মহারথী মানব আছেন যারা কিনা প্রতি মুহূর্তে নবীর ﷺ সাথে বর্তমান। সাইয়িদিনা ওমর (রা) এবং সাইয়িদিনা ওসমান (রা) - তাঁরাও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবাদের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত। তবে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব আছে। নকশবন্দী তরিকায় এই দুই শাখা (সাইয়িদিনা আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা) এবং সাইয়িদিনা আলী (রা)) একসাথে সংযুক্ত হয় সাইয়িদিনা জাফর আস-সাদেকের ভেতর দিয়ে। আমরা যখন এই দুই শক্তিশালী প্রবাহের সাথে একসাথে চলমান থাকি শয়তান তখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এটার ইঙ্গিত হলো, দুনিয়া তখন তোমার পেছনে পেছনে চলা শুরু করে দেবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা দুনিয়ার দাস হয়ে পড়ে আছি। আমরা কাজের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছি, দুনিয়ার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছি।

ইন্দামা তাতাজাররাদ মিন তাবি'আতি নাফশাক আল-হায়ওয়ানিয়াহ। তুমি যখন নিজের ভেতর থেকে পাশবিক বৈশিষ্ট গুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারবে, যখন উজুদ আল-ইকমানি, সম্ভাবনার অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, তখন তুমি আল-উজুদ আল-জামি, সমষ্টিগত অস্তিত্বে এসে পৌঁছতে পারবে। নিজের নফসের একক অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হতে পারলে তুমি আল্লাহ্‌র ঐশী উপস্থিতিতে সমস্ত আউলিয়া এবং সমস্ত নবীদের মাহফিলে যুক্ত হবে। আল-উজুদ আল-ইকমানি লা কিইমা লাহু, সম্ভাবনার অস্তিত্বের কোন মূল্য নাই। আল-উজুদ আল-ইলাহি লাহু কুল্লু কিইমাহ ... মারিফাত উল-কা'আরি। ঐশ্বরিক অস্তিত্ব এতটাই মূল্যবান একটা সাগর যার গভীরতার কোন সীমা নাই। তুমি ডুব দিলে, আবার ডুব দিলে, অথচ এমন যে তুমি কখনও সেখানে ডুবে যাওনি। আর সেজন্যই "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" তোমাকে উজুদ-ইলাহি, সত্য অস্তিত্বে পৌঁছে দেয়। দুনিয়ার বুকে তুমি যদি বলতে থাকো, 'লা ইলাহা ইল্লা আনা', সেটাই আমাদের কাজকর্মের সত্য পরিচয় - যেভাবে আমরা বলেই চলেছি, 'আমি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নাই'। সেটা তো তোমাকে কোথাও পৌঁছে দিতে পারবে না। দুনিয়া তোমার প্রভু হয়ে যাবে আর তুমি হয়ে যাবে দুনিয়ার ভৃত্য। যখন বলবে, "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" কেবল মাত্র তখনই দুনিয়া তোমার ভৃত্য হয়ে যাবে। কাজেই সেটা ইখলাসের সাথে, আন্তরিকতার সাথে বলো, তাহলে আল্লাহ্‌ তোমার হৃদয়ের ভেতরে ইখলাসের মাকামকে উন্মোচিত করে দেবেন।

আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন, আশীর্বাদপুষ্ট করুন, এবং আমরা এই বিষয়ে আগামীতে আবারও আলোচনা করব।

ওয়া মিন আল্লাহি 'তৌফিক, বি হুরমাতি 'ল-হাবিব, বি হুরমাতি 'ল-ফাতিহা।

মাকাম-উল-ইখলাস, আন্তরিকতার মাকাম

মওলানা শেখ হিশাম কাব্বানি

সেপ্টেম্বর ৫, ২০১০, মিশিগান

ফজর, রমজান সিরিজ

কপিরাইট 2024 sufilive.com

UA-984942-2