Go to media page Available in: English   Bengali  

মুরিদের কপালের তিনটি পেরেক, তিনটি আদব

~ মওলানা শেখ হিশাম কাব্বানি

রমজান, ২০১৫, জুলাই ২, মিশিগান

মুরিদের কপালের জন্য তিনটি পেরেক

আল্লাহ্‌র অলিদের প্রতিদিনের জিকির ঠিক কেমন? "ইয়া আফুউ, ইয়া গাফফার", আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে - সেই কথা সব সময়েই মনে হতে থাকে তাদের। সেটা তাদের আদব। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে আদব শিক্ষা দিচ্ছেনঃ "আমার কাছে সরাসরি আসবে না, আমার রসুল ﷺ সেখানে আছেন"।

وَأْتُواْ الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا

সঠিক দরজা দিয়ে বাসায় প্রবেশ করবে, [সুরা বাকারা ২:১৮৯]

যেই বাসার যেই দরজা সেখান দিয়েই তোমাকে প্রবেশ করতে হবে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে তো আর ঢুকে পড়া যায় না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন, তোমরা তো সরাসরি আমার কাছে এসে পৌঁছাতে পারবে না। যথাযথ আদব শিক্ষা করতে না পারলে মানুষ নিজের উপর নিজেই জালেম হয়ে যায়, অর্থাৎ তার অহংকার, নফস তার উপরে জুলুম করতে থাকে। "ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ, তাদেরকে তো আপনার কাছে আসতে হবে", এটার রূহানী ব্যাখ্যা এরকম; আর আক্ষরিক অর্থঃ "তারা যখন নিজেদের উপর জুলুম করে, তখন সাইয়িদিনা মুহাম্মাদের ﷺ কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করো"। সমস্ত উম্মতের হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুদায়িত্ব তাঁর উপরে অর্পণ করা হয়েছে। সমস্ত উম্মতের সাথেই কথা বলে চলেছেন তিনি।

وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَآؤُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللّهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا

আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত। [সুরা নিসা - ৪:৬৪]

যখন তারা জালেম, তারা জানে, ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ, আপনি ছাড়া অন্য কোন দরজা তাদের সামনে নাই। আপনি তাদের হয়ে ইস্তিগফার করবেন, ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। যদিও তারা নিজেরাও ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, আস্তাগফিরুল্লাহ বলেছে, কিন্তু সেই ইস্তিগফারের সাথে মিশে আছে তাদের বদ আদব আর বদ চরিত্র। কাজেই আপনার কাছে আসা ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোন উপায় নেই, ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ। আপনি নিজে যখন তাদের হয়ে ইস্তিগফার করেন, ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তখন তাদের সেই ইস্তিগফারগুলো পুণ্য হয়ে যায়, আর কেবল তখনই সেগুলো গৃহীত হয়, কেননা আদবের সর্বোচ্চ মাকাম হলেন আপনি নিজেই। আল্লাহ্‌ বলছেন, সমস্ত আদম সন্তানের জন্য সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণা দিচ্ছেন আল্লাহ্‌ সুবহানাহুতা'আলাঃ

وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ

আপনি অবশ্যই অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী। [সুরা কালাম - ৬৮:৪]

অয়া ইন্নাকা লা'আলা খুলুকিন আজিম।

অসাধারণ, মহান, আজিম। ঠিক কেমন এই অসাধারণ? আমি বলতে পারি যে এটা ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষের একটা অসাধারণ মাহফিল। আমার জন্য এটা অসাধারণ, কেননা এখানে তো মাত্র দুই তিনজন মানুষ নেই, সেই তুলনায় ৫০-৬০ মানুষের জমায়েত অসাধারণ তো বটেই। যদি ১০০ মানুষ হয় - তো সেটা আরও অসাধারণ। যদি এক লাখ মানুষ জমা হয়ে যায় তাহলে আরও বেশি অসাধারণ। কিন্তু তারপরেও সেটা তো 'আজিমতের' দিগন্তও ছুঁতে পারেনি এখনও। আর তার মানেই হলো আদবের কোন সীমা নেই, শেষ নেই, প্রতি মুহূর্তেই তুমি আরও উৎকৃষ্ট আদবের দিকে এগিয়ে চলেছ। আমরা যখন আল্লাহ্‌র রসুলের ﷺ প্রতি আদব প্রদর্শন করি, তখন একই সাথে এটাও প্রমাণিত হয়ে যায় যে আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছে যাবার জন্য আমাদের দরজা কেবল তিনিই। সেই দরজার নামই রাহমাতাল্লিল আলামিন, সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত তিনি - কেবল তখনই সেই নবী ﷺ তোমাকে সেই অসাধারণ আদবের সাজে সাজিয়ে দিতে থাকবেন, যেই আদব, যেই আজিমত এই পুরো মাখলুকাতের চাইতেও বড়, যার তুলনায় আকাশ, জমিন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, কোন কিছুই যথেষ্ট নয় - একটা বিশাল মরুভুমির বুকে পড়ে থাকা একটা আংটি যেমন তুচ্ছ - সেরকম।

কাজেই আদব হলো নবীর ﷺ কাছে যাওয়া, নবী ﷺ সেই দরজা যার কথা আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। তখন তোমাকে দিক নির্দেশনা দেবে কে? নফস, বদ লালসা, দুনিয়ার ভালবাসা আর ইবলিসের ফিসফিসানিকে ভেতরে রেখে তো তুমি নিজেকে নিজে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। তোমার ভেতরটাকে পাঁক সাফ করে নেয়ার জন্য দিক-নির্দেশক থাকা, একজন গাইড থাকা আবশ্যক। নোংরা পাতিলে যেমন রান্না করা যায় না সেরকম নোংরা হৃদয়ে দরূদ শরীফ পড়ে কতটা ফায়দা হাসিল করা যাবে? আর সেজন্যই ওলামা এবং আল্লাহ্‌র সত্যনিষ্ঠ আউলিয়া তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের তরিকার গ্র্যান্ডশেখ এভাবে "তিনটি আদব" শিক্ষা দিয়েছেন, যাকে আমরা বলি "তিনটি মূল নীতি" অথবা "তিনটি পেরেক", যা কিনা প্রতিটি মুরিদের কপালে ধারণ করা আবশ্যক।

১) তুমি যদি পশ্চিমে থাকো আর তোমার রিজিক থাকে পূবে, তাহলে তোমার শেখ তোমাকে হুকুম করবেনঃ যাও, যেখানে আল্লাহ্‌ তোমার রিজিক রেখে দিয়েছেন, সেখানে যাও, যেভাবে একটা পিঁপড়া জানে, তার রব তাকে কোথায় যাবার জন্য হুকুম করেছেন। হয়ত পথে তোমার মৃত্যু হবে, রূহানী শক্তি ছাড়া তুমি পৌঁছাতে পারবে না। তবুও এটা তো বলতে পারবে যে, "আমাকে পশ্চিম থেকে পূবে যাবার জন্য হুকুম করা হয়েছে।" সেটাই একজন মুরিদের জন্য যথেষ্ট। আর তখন ওই পিঁপড়ার মতো করে সে পথ চলতে থাকবে। যেতে যেতে সে ভয়ে চিৎকার করে বলতে থাকবে না যে, "আমি কিন্তু মরে যাচ্ছি, ভাই, এই যে দেখেন, কি সাংঘাতিক অসুবিধার ভেতরে আমি আছি, মরে গেলাম, মরে গেলাম"। না; আল্লাহ্‌ যেভাবে তোমাকে হুকুম করেছেন তুমি সেভাবেই চলতে থাকবে, যেভাবে আল্লাহ্‌ বলেছেন, "নবী ﷺ যা দেবেন সেটা গ্রহণ করবে" [সুরা হাশর ৫৯:৭]।

২) তারা যদি তোমাকে একটা ভাঙা শাবল দিয়ে বলেন, "যাও, ওখানে গিয়ে খুঁড়তে শুরু করো, তোমার আমানাত, তোমার ট্রাস্ট সেখানে লুকোনো আছে, গুপ্তধনের মতো", তুমি কি করবে তখন? ডানে বামে অনেক লোকে বলবে, "দাঁড়াও বাপু, এই ভাঙা শাবল দিয়ে তো তিন হাত মাটিও খোঁড়া সম্ভব না, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ, নাকি?" এর অর্থ কি? খুব সোজা। ওরা ওদের মনকে ব্যবহার করছে, অন্তরকে নয়। এই একই কথা তুমি যদি একটু ঘুড়িয়ে ওই একই লোককে বলো? যদি তুমি বলো, "এই যে, এই ভাঙা শাবলটা নাও, ওখানে না একটা ভীষণ দামী খাঁটি হীরা লুকোনো আছে, খুঁড়লেই পেয়ে যাবে"। তোমার কথা শেষ হবার আগেই সে তোমার হাত থেকে ভাঙা শাবল কেড়ে নিয়ে খুঁড়তে শুরু করবে। কি, করবে না? শাবলটা কেমন, ভাঙা নাকি শক্তপোক্ত, দেশী নাকি বিদেশী, পরিষ্কার নাকি কাদামাখা - আর কোন কিছুর দিকেই সে কোন দৃষ্টিপাত করবে না, কেন? কারণ দুনিয়ার লোভ, হুব্বুদ'দুনিয়া দিয়ে তার ভেতরটা ভরে আছে।

আমাদের শেখ, শিক্ষক, গুরু, পীর, মুর্শিদ - প্রথম তাঁরা আমাদেরকে এই কথাটা বলেন, "তোমার নামাজ পড়তে থাকো, ছেড়ে দেবে না, সেটাই তোমার শাবল, ভাঙা শাবল। খুঁড়তে থাকো, তোমার আমানত তুমি পাবেই পাবে। অথচ আল্লাহ্‌ কি বলছে সেটা মানুষ শুনতেই চায় না। দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে থাকে তারা। কাজেই আদব হলো খুঁড়তে থাকা, প্রশ্ন না করা, সন্দেহ না করা। এটাই আল্লাহ্‌র হুকুম, এটাই শরিয়ত, আর তার বিরুদ্ধে তুমি মনগড়া কোন অজুহাত খাড়া করতে পারো না।

৩) কেউ যদি তোমার হাতে একটা বালতি ধরিয়ে দিয়ে বলে, যাও, এই বালতিটা নিয়ে সমুদ্রের তীরে যাও আর সাগরকে খালি করে দিয়ে এসো। মানে কি? একটা একটা করে বালতি ভরে পানি তুলবে আর পেছন দিকে ফিরে সৈকতের উপরে ফেলে দেবে। আরে, কি আশ্চর্য কথা! এটার কোন অর্থ আছে? হ্যা, আছে। সমুদ্রের তলায় তোমার জন্য হীরা রাখা আছে, পান্না রাখা আছে, মুক্তো রাখা আছে। না খালি করলে সেটা তুমি পাবে কেমন করে?

সোনা কেমন করে তোলে, জানো? সোনার জন্য খনি খুঁড়তে হয়। পানি থেকে পাথর তুলে তুলে ছেঁকে নিতে হয়। তখন ঠিকই তারা বালতি ব্যবহার করে, শাবল দিয়ে, মেশিন দিয়ে মাটির নিচে গভীর গর্ত খুঁড়ে নেয়। অথচ আল্লাহ্‌র অলি যখন বলেন, যাও, বালতি দিয়ে সমুদ্র খালি করা শুরু করো, তোমার রূহানী আমানত তুমি পেয়ে যাবে - মানুষ তখন বলতে থাকে - কি অসম্ভব - কি ফালতু এসব কথা। আল্লাহ্‌র জন্য অসম্ভব বলে কিছুই নাই। তিনি পছন্দ করেন, সামি'আনা ওয়া আতা'আনা, যা কিছু আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসুল ﷺ আমাদের জন্য হুকুম করেন আমরা সেটা শুনি এবং মান্য করি। আল্লাহ্‌র নিরহংকার আন্তরিক বান্দারা যা কিছু হুকুম করেন, আমরা সেটা শুনি এবং মান্য করি। যেভাবে আল্লাহ্‌ বলছেন,

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

বলুন, (ও মুহাম্মাদ), "তোমরা যদি (সত্যিই) আল্লাহ্‌কে ভালবেসে থাকো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপের ক্ষমা করবেন, আল্লাহ্‌ মহাক্ষমাশীল, পরম দয়ালু"। [সুরা ইমরান, ৩:৩১]

আর আল্লাহ্‌র সেই আন্তরিক নিষ্ঠাবান বান্দা আসলে কারা - সেই বিষয়ে আমাদের জেনে ওঠার এখনও অনেক অনেক অনেক বাকি আছে।

মুরিদের কপালের তিনটি পেরেক, তিনটি আদব

~ মওলানা শেখ হিশাম কাব্বানি

রমজান, ২০১৫, জুলাই ২, মিশিগান

UA-984942-2